গত ৩ জুন ২০২১-এ প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট এমন সময়ে ঘোষণা করা হলো যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূরণ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাক খাতের প্রতি সহায়তা বজায় রাখতে অতিরিক্ত ১ শতাংশ নগদ সহায়তার পাশাপাশি বিদ্যমান রপ্তানি প্রণোদনাসমূহ অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও, গৃহীত পদক্ষেপসমূহ এই খাতে কর্মরত অসংখ্য শ্রমিকের জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে যথেষ্ট কিনা তা জানতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
দারিদ্র্য বিমোচন, সম্পদের পুনর্বন্টন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সরকারের আয় ও ব্যায়ের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করাই বাংলাদেশের মতো দেশের বাজেটের লক্ষ্য থাকে। কিন্তু, এবারের বাজেট ঘোষণার সাথে সাথে পোশাক শ্রমিকদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য আমরা প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছি।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৬৩% পোশাক শ্রমিকের বাজেট কি বা তা কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। এদের মধ্যে প্রায় ৭১% উত্তরদাতা নারী ও ৩৮% পুরুষ। বাজেট সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে বলে দাবি করেছেন, এমন ৩৭% উত্তরদাতার মধ্যে অধিকাংশ মনে করেন বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত ও দরিদ্রদের জন্য সহায়তার মতো বিষয়গুলো আরও অগ্রাধিকার পাওয়া উচিৎ ছিলো।
দ্রষ্টব্যঃ ব্লগে ব্যবহৃত ছবিটি বাংলাদেশের একজন পোশাক শ্রমিকের অনুমতিক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে।পূর্ণসংখ্যায় রুপান্তর করার কারণে গ্রাফে উল্লিখিত শতাংশের সমষ্টি ১০০ নাও হতে পারে।
জাতীয় বাজেটের সুফল
জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় অর্ধেক শ্রমিক তাদের ব্যক্তিগত জীবনে জাতীয় বাজেট কি ধরণের প্রভাব ফেলে তা জানেন না। ১৩% উত্তরদাতা মনে করেন যে বাজেট দ্বারা তারা উপকৃত হয়েছেন এবং ৩৯% মনে করেন বাজেট দ্বারা তাদের কোন উপকার হয় নি। বাজেট তাদের কি উপকার করেছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে নারী ও পুরুষদের উত্তরে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।
একদিকে, পুরুষদের থেকে ২২% বেশী নারী উত্তরদাতা দাবি করেছেন যে তারা সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন। অপরদিকে, নারীদের থেকে ১৭% বেশী পুরুষ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন বাজেট দেশের সার্বিক উন্নয়ণে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। ১০% নারী উত্তরদাতা মনে করেন যে বাজেটের ফলে কারখানায় বাড়তি সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কোন পুরুষ উত্তরদাতাই নারীদের সাথে একমত হতে পারেননি।
জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ শ্রমিকদের পরিস্থিতি উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখেনি এমন ধারনার পিছনে মূল যে কারণগুলো উঠে এসেছে তা হলো, মূল্যস্ফীতি, বেতন-বোনাস বৃদ্ধি না পাওয়া ও কোন সরকারি সহায়তা না পাওয়া।
সরকার ঘোষিত বাড়তি সুবিধা সমূহ তৈরী পোশাক রপ্তানিকারকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তবে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি যে এই খাতকে চলমান রাখতে যারা মূল ভূমিকা রাখছে, সেই শ্রমিকদের কাছে সুবিধার কোন অংশ পৌছেছে কিনা। ঘোষিত সুবিধা সমূহ শ্রমিকদের বেতন-বোনাস বৃদ্ধিতে কতোটা ভূমিকা রেখেছে, শ্রমিকদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে তাদের ১ থেকে ১০ এর স্কেলে নাম্বার দিতে বলা হয়েছিলো, (১= কোন সুবিধাই শ্রমিকদের কাছে পৌছায় না এবং ১০= শ্রমিকদের কাছে সকল সুবিধাই পৌছায়)। অর্ধেকের বেশী উত্তরদাতা ১-৩ এর নাম্বার দিয়েছেন, অর্থ্যাৎ তারা মনে করেন তেমন কোন সুবিধাই শ্রমিকদের কাছে পৌছায় না, ৪-৬ নাম্বার দিয়েছেন ৩০% এবং মাত্র ১১% উত্তরদাতা ৭-১০ স্কোর দিয়েছেন।
শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা
জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৯৭% মনে করেন যে মহামারীর মধ্যে কর্মহীন হয়েছেন এমন শ্রমিকদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকা উচিৎ ছিলো। ৮৬% মনে করেন বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য বাড়তি সহায়তার ব্যবস্থা করা উচিৎ। শ্রমিকদের বেকার ভাতা দেয়া উচিৎ এমনটা মনে করেন প্রায় ৯২% উত্তরদাতা।
বর্তমানে তৈরী পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের নূন্যতম কি পরিমাণ সহায়তা দেয়া উচিৎ, এমন প্রশ্ন করলে অধিকাংশ উত্তরদাতা ১,০০০-৫,০০০ টাকা সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। অন্যদিকে, মহামারীর মধ্যে চাকরি হারানোদের ব্যাপারে জানতে চাইলে নূন্যতম ৫,০০১-১০,০০০ টাকা সহায়তা দেয়া উচিৎ বলে উত্তর পাওয়া যায়। একই সাথে অধিকাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বেকার শ্রমিকদের নূন্যতম ১,০০১-৫০০০ টাকা ভাতা দেয়া উচিৎ।
অর্থ সাহায্য ছাড়া অন্য আর কি ধরণের সহায়তা প্রয়োজন জানতে চাইলে অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবার কথা বলেন। সেই সাথে স্কুলে সহায়তা এবং শিশুস্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
গত ৯ থেকে ১১ জুলাই, ২০২১-এ সর্বমোট ১,২৯৫ জন শ্রমিকের মধ্যে পরিচালিত জরিপ থেকে এসকল তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা বাংলাদেশের ৫ টি মূল শিল্পাঞ্চলের (চট্টগ্রাম, ঢাকা শহর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং সাভার) বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত। উত্তরদাতাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশের কিছুটা বেশী নারী শ্রমিক, যা এই খাতের সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন।