POST

মানবাধিকার ও পরিবেশ সংক্রান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে এর প্রভাব

সেলিম রায়হান ও ওমর রাদ চৌধুরী

বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাজারের একটি বড় আসন দখল করে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মত দেশগুলো। তবে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানির বাজারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভাবশালী ভূমিকা রাখছে যা পোশাক রপ্তানির বাজারে প্রায় ৫০% এর বেশি। ইইউ এর দেশগুলোর ক্ষেত্রে এভরিথিং বাট আরমস (ইবিএ) ইনিশিয়েটিভ এর অধীনে আমদানির বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 

ইউরোপীয় পরিসংখ্যান অফিস (ইউরোস্ট্যাট) এবং বিজিএমইএ দ্বারা প্রকাশিত সর্বশেষ আমদানি তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ইইউতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৪৪.৬ শতাংশ বেড়ে ১১.৩১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে, বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ৭.৮২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে। ফলে ইইউতে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে আছে।

 

ইইউ বাজারের গুরুত্ব বিবেচনা করে, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য ইইউ-এর মানবাধিকার এবং পরিবেশগত বিধি (HREDD) মেনে চলা আবশ্যক। এইচআরইডিডি বিধি ব্যবসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক পদক্ষেপগুলো চিহ্নিতকরণ, প্রতিরোধ এবং প্রশমিত করে।

 

বাংলাদেশের পোশাক খাতে মানবাধিকার চর্চা এবং পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে খুব বেশি সচেতনতা দেখা যায় না। কম মজুরি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, বিপজ্জনক কাজের পরিবেশ, পেশাগত নিরাপত্তা, এবং মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিসেবাসহ বিভিন্ন সমস্যা শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সামগ্রিক কল্যাণের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। পোশাক খাতের জন্য যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত রাখা হয়েছে তা শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। গত কয়েক দশকে কিছু উন্নতি দেখা গেলেও, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা এই সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। পরিবেশগত প্রভাব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র যেখানে পোশাক খাতকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

 

এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিউ ডিলিজেন্স (HREDD)- প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এই আইনটি ইউরোপিয়ান কোয়ালিশন ফর কর্পোরেট জাস্টিস (ECCJ) দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। একই সাথে এটি বোঝায় যে একটি ব্যবসাকে অবশ্যই তার পণ্যের সম্ভাব্য সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি, প্রশমন এবং প্রতিরোধমূলক পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, কর্মক্ষমতা নিরীক্ষণ করতে হবে এবং এই কার্যক্রমগুলি সম্পর্কে তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে।

 

ইইউতে তৈরি পোশাকের অন্যতম সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশ HREDD বিধি আওতায় পড়ে। বাংলাদেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যে ইইউ ব্র্যান্ডগুলি সম্পৃক্ত, তাদের ইউনিয়নের এই আইন অনুসারে বাংলাদেশের পোশাক খাতে মানবাধিকার এবং পরিবেশগত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রশমন কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। HREDD বিধান মেনে চলতে ব্যর্থ হলে RMG ম্যানুফ্যাকচারারদের সাথে চুক্তির অবসান ঘটতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এইচআরইডিডি প্রবিধানের কিছু প্রভাব দেখা যায়।

 

প্রথমত, HREDD একটি রেগুলেশন ম্যান্ডেট হিসাবে, বাংলাদেশ থেকে যেসব RMG পণ্য পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলিতে যায়, সেখানে সাপ্লাই চেইন জুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পরিবেশগত প্রভাব নিরীক্ষণের জন্য আরও শক্তিশালী প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে। এই ধরনের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশী উৎপাদনকারীদের সেই অনুযায়ী মানসম্মত কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে।

 

দ্বিতীয়ত, এইচআরইডিডি প্রবিধানের আইনি কাঠামোর জন্য ইইউ বাজারে বাংলাদেশ প্রবেশাধিকার হারাতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশের আরএমজি রপ্তানির ব্যাপকতা ইইউতে বেশি, তাদের বাজারে প্রবেশাধিকার হারানোর ফলে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় ক্ষতি হতে পারে।

 

তৃতীয়ত, EU অঞ্চলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতাদের ধরে রাখতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রতিটি পদক্ষেপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য ইইউ কাঠামোর মধ্যে প্রাসঙ্গিক প্রশাসনিক সংস্থাগুলির পাশাপাশি মানবাধিকার এবং একটি টেকসই পরিবেশ নিয়ে কাজ করা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাথে গভীর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।

 

চতুর্থত, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি HREDD প্রবিধানের কেন্দ্রীয় বিষয়। এর ফলে গ্রিন ম্যানুফাকচারিং নিশ্চিত করতে নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।

 

পরিশেষে আলোচনার শেষে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, HREDD প্রবিধান মানবাধিকার এবং পরিবেশগত সচেতনতা নিশ্চিত করতে একটি নতুন ও শক্তিশালী প্রক্রিয়ার সূচনা করবে। আরএমজি সেক্টরের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখার জন্য, বাংলাদেশে আরএমজি সেক্টরের নীতিনির্ধারক এবং স্টেকহোল্ডারদের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সেই অনুযায়ী পরিবেশগত অবস্থার উন্নতির জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

 

সেলিম রায়হান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম। ইমেইল:

selim.raihan@gmail.com

 

ওমর রাদ চৌধুরী, গবেষণা সহযোগী, সানেম। ইমেইল: omar.raad.chowdhury@gmail.com

 

দ্রষ্টব্যঃ ব্লগে ব্যবহৃত ছবিটি বাংলাদেশের একজন পোশাক শ্রমিকের অনুমতিক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে।