POST

ইউরোপীয় ইউনিয়নের HREDD বিধিমালাঃ বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যত

সেলিম রায়হান ও ওমর রাদ চৌধুরী


ইউরোপীয় ইউনিয়নের HREDD বিধিমালা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) সেক্টরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। HREDD প্রবিধান এর আওতায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্র্যান্ড বা এন্টারপ্রাইজগুলো তাদের সাপ্লাই চেইনে মানবাধিকার এবং পরিবেশগত অবস্থার নিরীক্ষণ করে। যদি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো HREDD প্রবিধান মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এন্টারপ্রাইজগুলো আইনি ব্যবস্থা নেয়া সহ চুক্তির অবসান ঘটাতে পারে।

 

 

ইইউ বাংলাদেশের আরএমজি রপ্তানি বাজারের ৫০ শতাংশের বেশি অংশে বিদ্যমান, তাই মানবাধিকার এবং পরিবেশে প্রভাব মূল্যায়ন করা দেশের নীতিনির্ধারক এবং আরএমজি সেক্টরের স্টেকহোল্ডারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আরএমজি খাতে নানাবিধ সমস্যা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে বহুদিন ধরে চলমান সমস্যাগুলো হল- কম মজুরি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, বিপজ্জনক কাজের পরিবেশ, পেশাগত নিরাপত্তা, এবং পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ।

 

 

RMG কারখানায় চাকরির নিয়োগের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এই খাতে বেশিরভাগ সময় কোন সরকারী রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না এবং মৌখিকভাবে চুক্তি দেয়া হয়। অফিসিয়াল চুক্তির অভাবে কর্মীরা তাদের অভিযোগের সমাধান করার জন্য আইনি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য পায়না। অনেকসময় নিয়োগকর্তা এ ধরনের আনঅফিসিয়াল চুক্তির সুযোগ নিয়ে কর্মীদের উপর অতিরিক্ত কাজের ভার দেয়।

 

 

আরএমজি সেক্টরের জন্য নির্ধারিত যে ন্যূনতম মজুরি রয়েছে তা শীর্ষ আরএমজি উৎপাদনকারী দেশগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ন্যূনতম মজুরির মূল্য সময়ের সাথে সাথে হ্রাস পেয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে ৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে। আঙ্কার পদ্ধতি ব্যবহার করে, গার্মেন্টস ওয়ার্কার ডায়েরি (GWD) রিপোর্ট দিয়েছে, কর্মীদের জীবন ধারনের জন্য নূন্যতম  মজুরির পরিসীমা ঢাকাতে ১৯,২০০ টাকা থেকে ২২,৯০০ টাকা, চট্টগ্রামের জন্য ২১,৩০০ থেকে ২৬,০০০ টাকা এবং গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং সাভারের জন্য ১৯,২০০ থেকে ২২,৯০০ টাকা। GWD-এর মতে, ২০২২ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে  কর্মীদের গড় আয় (ওভারটাইমের হিসাব ছাড়া)  ছিল ৯,৯৮৪ টাকা    (মহিলাদের জন্য ৯,৬৬৮ টাকা এবং পুরুষদের জন্য ১০,৯২৮ টাকা)। এর ফলে জীবন ধারনের জন্য নূন্যতম  মজুরির ও প্রাপ্য মজুরির ব্যবধান নারী শ্রমিকদের জন্য ৫১ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ এবং পুরুষ শ্রমিকদের জন্য ৪৫ শতাংশ থেকে ৫৪ শতাংশ দেখা যায়। এলাকা এবং লিভিং ওয়েজ বেঞ্চমার্কের উপর নির্ভর করে, বর্তমান মজুরি ব্যবধান মহিলাদের জন্য ৯,৪০৮ টাকা (৪৯ শতাংশ) থেকে ১৫,৬১৬ টাকা (৬০ শতাংশ)। পুরুষদের জন্য এ ব্যবধান ৭,৯৪৭ টাকা (৪১ শতাংশ) থেকে ১৪,৪০০ টাকা (৫৫ শতাংশ)। এই ব্যবধান মেটানোর জন্য, কর্মীরা আইনি সীমা অতিক্রম করে ওভারটাইম কাজ করে।

 

 

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার RMG কর্মীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য উদ্বেগ একটি গুরুতর সমস্যা যার পেছনে দায়ী মানহীন কাজের পরিবেশ। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর এবং অতিরিক্ত ধুলাবালি কর্মীদের জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরএমজি কর্মীদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশী এবং ভারতীয় আরএমজি কর্মীরা অন্য দেশের কর্মীদের তুলনায় বেশি ভুক্তভোগী।

 

 

রানা প্লাজা ট্রাজেডি বাংলাদেশের RMG সেক্টরে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে যা আরএমজি সেক্টরের ভবিষ্যতের জন্য আশংকা জনক। পশ্চিমা দেশগুলো এ ঘটনার পরে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোকে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বলেছে এবং আরএমজি ফ্যাক্টরিগুলো তা মেনে না নিলে প্রেফারেনশিয়াল স্ট্যাটাস প্রত্যাহার করার হুমকি দিয়েছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপের ফলে ২০১৩ সালে Accord এবং Alliance প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৭ সালের SANEM-ILO বেসলাইন গবেষণা অনুসারে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে এখনও কিছু উদ্বেগ আছে।

 

 

মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আরেকটি বড় উদ্বেগ হল জেন্ডার বেসিসে মজুরির ব্যবধান। GWD-এর ডেটা নির্দেশ করে যে, সমস্ত গ্রেডে কর্মীর অভিজ্ঞতার স্তর এবং শিক্ষাকে বিবেচনায় নিয়ে, মহিলাদের পুরুষদের তুলনায় প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৫ টাকা কম বেতন দেওয়া হয়। এটি আরো নির্দেশ করে যে মহিলারা পুরুষদের উপার্জনের প্রায় ৯০ শতাংশ আয় করে।

 

 

নিজেদের অধিকার আদায়ে কথা বলার জন্য শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের ক্ষমতা এখানে সীমিত। শ্রমিক এবং ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের রিপোর্ট অনুসারে, নিয়োগকর্তারা সাধারণত ইউনিয়ন করার এবং দর কষাকষিতে জড়িত শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি অসহিষ্ণু। যে কর্মীরা এ ধরনের কার্যকলাপ সংগঠিত করে তাদের অনেকসময় বরখাস্ত করা হয়, চাকরিচ্যুত করা হয় এবং নির্বাচিত ইউনিয়ন সদস্যদের কর্মক্ষেত্র থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। এ সকল কাজ কর্মীদের সাংগঠনিক গতিবিধি প্রতিরোধ করে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ১৩ (১) অনুসারে, একটি এন্টারপ্রাইজের মালিক একটি বেআইনি ধর্মঘটের কারণে একটি কারখানা বা অন্য প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা বা বিভাগকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে রাখতে পারে। এছাড়াও, অবৈধ ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকরা শাখা বা বিভাগ বন্ধ করার ক্ষেত্রে কোনও মজুরি পাবেন না।

 

 

প্রকৃতপক্ষে, কর্মীদের জবরদস্তি এবং হয়রানি এই সেক্টরে একটি প্রচলিত রীতি। লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা, চিৎকার, অপমানজনক ব্যবহার, আঘাত, চুল টেনে ধরা- ইত্যাদি প্রবণতা প্রায়শই দেখা যায়।। রিপোর্ট অনুসারে, এগুলি মহিলা কর্মীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এবং এটি করা হয় উৎপাদন লক্ষ্য পূরণ, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য এবং সময়সীমা পূরণের জন্য।

 

 

বাংলাদেশ সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব পোশাক উৎপাদনে প্রশংসনীয় হয়েছে—দেশের ৮২টি পোশাক কারখানা ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) থেকে এলইইডি (লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন) সার্টিফিকেশন পেয়েছে। আরও ৩২০টি কারখানা বিশ্বের সর্বোচ্চ-স্তরের LEED সার্টিফিকেশনের জন্য নিবন্ধিত হয়েছে —যা আরএমজি শিল্পক্ষেত্রে বর্জ্য পানি নিষ্কাশন এবং রাসায়নিক ব্যবহার নিয়ে কাজ করে। এক্ষেত্রে, আরএমজি সাপ্লাই চেইনসহ ম্যানুফ্যাকচারিং পদ্ধতিগুলোর ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া দরকার। তৈরি পোশাক খাতের পানি ও বায়ু দূষণের পেছনে ওয়াশিং, ডাইং এবং ফিনিশিং (ডব্লিউডিএফ) ইউনিটগুলি মূলত দায়ী বলে দেখা গেছে।

 

 

পানি দূষণের ক্ষেত্রে, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, কাপড় ধোয়া, রং করা এবং ফিনিশিংয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পরিষ্কার পানি প্রয়োজন, যার পরিমাণ প্রতি টন টেক্সটাইলের ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ৩০০ ঘনমিটার। একটি সাধারণ বাংলাদেশী শিল্প কারখানা প্রতিদিন ৩০০ লিটার পানি ব্যবহার করে। অনুমান করা হয় যে, বার্ষিক পাঁচ মিলিয়ন টন টেক্সটাইল উৎপাদন হয়। ডাব্লুডিএফ ইউনিটগুলোতে এই পরিষ্কারকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক যোগ করার পাশাপাশি স্টার্চ অপসারণ করে। এরপর এই তরল বর্জ্য অবশিষ্ট জৈব যৌগ, রাসায়নিক এবং পানি আকারে মিল থেকে নির্গত হয়। ২০০৭ সালে আইডব্লিউএম দ্বারা পরিচালিত একটি দূষণ সমীক্ষা অনুসারে, শিল্প উৎস, বিশেষ করে টেক্সটাইল, ট্যানারি এবং ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পগুলি ছিল ঢাকার জলাশয়ে প্রধান দূষণকারী।

 

 

বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে, WDF সেক্টর প্রচুর বাষ্প এবং গরম পানি তৈরি করে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে বাড়িয়ে তোলে। নাইট্রাস অক্সাইড এবং সালফার ডাই অক্সাইড প্রায়শই পানি গরম করার কাজে ব্যবহৃত শিল্প বয়লার দ্বারা নির্গত হয়। ক্লোরিন ডাই অক্সাইড ব্লিচিং প্রক্রিয়ার সময় নির্গত হয়, যেখানে ফ্যাব্রিক মুদ্রণের সময় অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোকার্বন নির্গত হয়। এ পদ্ধতিতে বায়ুমণ্ডলে ফর্মালডিহাইড নির্গত হতে পারে। জিন্স জাতীয় কাপড়ে পারম্যাঙ্গানেট ব্লিচ ব্যবহার ফুসফুসের এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। ডেনিম কাপড় হতে সিলিকোসিস “স্যান্ড ব্লাস্টিং” আসে যা প্রাণঘাতী হতে পারে।

 

 

এইচআরইডিডি প্রবিধান মেনে চলার জন্য, নীতিনির্ধারক এবং শিল্প স্টেকহোল্ডারদের বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই বিষয়ে, বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং টেকসই উৎপাদন অনুশীলনের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন প্রয়োজন। এই মূল্যায়ন স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতায় পরিচালিত হতে পারে।

 

 

শিল্প নীতি এবং উৎপাদন সংক্রান্ত আইনী কাঠামো উভয়কেই এইচআরইডিডি প্রবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য আপডেট করা দরকার। আরএমজি সেক্টরের মজুরি কাঠামোও এমনভাবে সংশোধন করা দরকার যাতে শ্রমিকরা একটি ভাল জীবনযাত্রা পেতে পারে। শ্রমিক, মালিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংলাপের জন্য একটি ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। এই ত্রি-পক্ষীয় সংলাপে শ্রমিকদের মঙ্গল ও মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

 

 

আরএমজি কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান জেন্ডার সমস্যাগুলি একটি ব্যাপক নীতি কাঠামোর মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়গুলির যথাযথ পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে সরকার এবং আরএমজি সেক্টরের স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা করতে হবে। বিশেষত, উৎপাদন ইউনিটগুলির সুরক্ষা প্রোটোকলগুলি অবশ্যই উচ্চতর মান ধরে রাখতে হবে।

 

 

একটি টেকসই পরিবেশ নীতি প্রয়োজন। এই নীতিটি আরএমজি সেক্টর জুড়ে গ্রিন প্র্যাক্টিস নিশ্চিত করবে। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য আরএমজি সেক্টরকে অবশ্যই তার পথ উদ্ভাবন করতে হবে। স্থানীয় নির্মাতাদের ব্র্যান্ড ইমেজ এমনভাবে গড়ে তোলার ওপর আরো জোর দেওয়া উচিত যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোক্তাদেরকে বাংলাদেশি আরএমজি সেক্টরে মানবাধিকারের উচ্চ মান এবং পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে আশ্বস্ত করা যায়।

 

 

সেলিম রায়হান, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম। ইমেইল: selim.raihan@gmail.com

 

 

ওমর রাদ চৌধুরী, গবেষণা সহযোগী, সানেম। ইমেইল: omar.raad.chowdhury@gmail.com

 

 

দ্রষ্টব্যঃ ব্লগে ব্যবহৃত ছবিটি বাংলাদেশের একজন পোশাক শ্রমিকের অনুমতিক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে।