POST

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজ ও কাজের চাপের ওপর ২০১৮ সালের ন্যূনতম মজুরি গেজেটের প্রভাব

গত তিন দশকে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং এই খাতটি দেশের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট জাতীয় রপ্তানির প্রায় ৮৩% এবং বাংলাদেশের জিডিপির ১১%-ই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে, একটি বিরাটসংখ্যক গার্মেন্টস শ্রমিক দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন এবং তারা অনেক ক্ষেত্রেই মৌলিক নাগরিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত। শ্রমিকদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এবং তাদের জীবনযাপনে ন্যূনতম মান নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সরকার গার্মেন্টস কারখানার এন্ট্রি পর্যায়ের চাকরির জন্য ন্যূনতম মজুরি মাসিক ৮০০০ টাকা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করে। এই নতুন নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ২০১৩ সালে নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির চেয়ে ৫১% বেশি। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয় ৫,৩০০ টাকা। ২০১৮ সালে গেজেট চূড়ান্ত হওয়ার আগে মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ এবং সরকারের মধ্যে আলোচনায় শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ১২,০২০ টাকা করার দাবি জানিয়েছিলেন। অন্য দিকে, গার্মেন্টস মালিকরা এন্ট্রি পর্যায়ের কাজের জন্য মজুরি প্রস্তাব করেছিলেন ৬,৩৬০ টাকা। প্রকাশিত গেজেট নিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা সন্তুষ্ট ছিলেন না, যেহেতু, নতুন নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরিতে তাদের কারখানা চালানোর খরচ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে, তা সত্ত্বেও ২০১৮র ডিসেম্বরে গেজেটটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। এটি ধরে নেয়া যেতে পারে যে, গেজেট ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির ফলে উৎপাদনের অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নিতে গার্মেন্টস মালিক এবং ব্র্যান্ডগুলো নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। যদি শ্রমিক ছাঁটাই, নির্ধারিত সময়ে শ্রমিকদের দেয়া পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধির মত পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে, তবে সেগুলো শ্রমিকদের ওপরও প্রভাব ফেলেছে।

দ্রষ্টব্যঃ ব্লগে ব্যবহৃত ছবিটি বাংলাদেশের একজন পোশাক শ্রমিকের অনুমতিক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে।পূর্ণসংখ্যায় রুপান্তর করার কারণে গ্রাফে উল্লিখিত শতাংশের সমষ্টি ১০০ নাও হতে পারে।

২০১৮ সালের গেজেট শ্রমিকদের ওপর আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেছে কি না এবং ফেলে থাকলে কী ধরণের সেটি বিশ্লেষণ করতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং মাইক্রোফাইন্যান্স অপরচুনিটিজ (এমএফও), ২০২১ এর নভেম্বরে ১২৭৮ জন শ্রমিকের ওপর একটি জরিপ চালায়। সম্পূর্ণ জরিপ এবং এ সংক্রান্ত বিশ্লেষণ শুধু সেই শ্রমিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, যারা জানিয়েছেন যে তারা ২০১৮র ডিসেম্বর থেকে একই কারখানায় কাজ করছেন। এমন শ্রমিক ছিলেন জরিপকৃত ১২৭৮ জনের মধ্যে ৭০২ জন বা ৫৫%। অন্যদিকে জরিপকৃতদের মধ্যে ৩৬% ‘১৮র গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পরে কারখানা পরিবর্তন করেছেন এবং বাকি ৯% গেজেট প্রকাশিত হওয়ার আগে কাজ করতেন না।

যে শ্রমিকরা কারখানা পরিবর্তন করেননি তাদের কাজকর্মে গেজেট প্রকাশের পরে কী ধরণের পরিবর্তন এসেছে সেটি জানতে জরিপে সেই শ্রমিকদের ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রশ্ন করা হয়। এদের মধ্যে ৫৮% জানিয়েছেন যে সচরাচর তারা যে ধরনের কাজ সবচেয়ে বেশি করে থাকেন তার মধ্যে আছে সেলাই, বয়ন, বুনন এবং এমব্রয়ডারি। এছাড়াও ফ্যাব্রিক যাচাই, কাটিং, ডায়িং, প্রিন্টিং এবং কাপড়ের মান নিয়ন্ত্রণের কাজও তারা করে থাকেন। এই শ্রমিকদের যখন বর্তমানের কাজের সাথে ২০১৮র গেজেটের আগের কাজের তুলনা করতে বলা হয়, তাদের মধ্যে ৫১% জানান যে আগে সেলাই, বয়ন, বুনন এবং এমব্রয়ডারি কিছুটা কম করতে হত। যে শ্রমিকরা “সেলাই লাইনে সহকারীর” কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাদের কাজ কর্মে পরিবর্তন এসেছে অনেকখানি: গেজেট ঘোষণার আগে ১১% শ্রমিক এই কাজ করতেন যেখানে এর পরে এখন মাত্র ৪% শ্রমিক একই কাজে নিয়োজিত।

জরিপে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই বর্তমান পদবি “অপারেটর”। অন্যদিকে ‘১৮র গেজেট প্রকাশের পর থেকে কর্মস্থল পরিবর্তন করেননি যে শ্রমিকরা তাদের মধ্যে ৬৭% এর পদবি বর্তমানে “অপারেটর”। মোট জরিপকৃতদের মধ্যে ১৬% শ্রমিকের পদবি আলাদা, ১৫% “হেল্পার”, ২% “সুপারভাইজার” এবং ১% নিজেদের পদবি সম্পর্কে অবগত নন। ২০১৮র ডিসেম্বর থেকে অপারেটর পদবিধারী শ্রমিকের সংখ্যা ৫৫% থেকে বেড়ে ৬৭% হয়েছে। হেল্পারের সংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে আরো অনেক বেশি—৩১% থেকে অর্ধেক কমে ১৫%।

একই কারখানায় নিয়োজিত এই শ্রমিকদের মধ্যে ৭৯% এখনো প্রোডাকশন লাইনে কাজ করেন। এদের মধ্যে ৬৩% জানিয়েছেন যে ২০১৮র ডিসেম্বর থেকে তাদের কাজের সার্বিক চিত্রে পরিবর্তন এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তরদাতাদের অর্ধেকের একটু কমসংখ্যক জানিয়েছেন গেজেট প্রকাশের আগে ১১ থেকে ২০জন শ্রমিক যে প্রোডাকশন লাইনে কাজ করতেন, সেখানে এখন ১ থেকে ১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। লক্ষ্যণীয়, এটি এই ইঙ্গিত দিতে পারে যে গেজেট ঘোষণার কারণে কিছু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।

একইভাবে, প্রোডাকশন লাইনে নিয়োজিতদের ৪৫% জানিয়েছেন যে গেজেট বাস্তবায়িত হওয়ার পরে লাইনে কাজ করা অপারেটরের সংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে। অন্যদিকে ৪২% জানিয়েছেন যে তাদের কাজ-কর্ম আগের মতই আছে। ৪৩% শ্রমিক জানিয়েছেন, ২০১৮র ডিসেম্বরের আগে একটি প্রোডাকশন লাইনে ৫০ জনের বেশি অপারেটর কাজ করতেন কিন্তু এখন সেটি অনেক কমে গেছে। বর্তমানে একটি প্রোডাকশন লাইনে ৫০ জনের বেশি কাজ করছে এমন চিত্রের কথা জানিয়েছেন উত্তরদাতাদের মাত্র ২৯%।

প্রত্যেক শ্রমিকের কাজের চাপ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, কারখানা পরিবর্তন করেননি এমন উত্তরদাতাদের ৮০% জানিয়েছেন যে ২০১৮র গেজেট প্রকাশের আগের তুলনায় তাদের কাজের চাপ বেড়েছে। এদের মধ্যে প্রোডাকশনে লাইনে নিয়োজিতদের ৫৮% জানিয়েছেন, নিজ নিজ লাইনে কাজ শেষ করার পরে তারা পর্যাপ্ত বিরতি পান না। উপরন্তু, এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জানান যে, নিজেদের লাইনে কাজ শেষ করেই তাদেরকে অন্য লাইন কাজ শুরু করতে হয়।

সবশেষে এটি উল্লেখ করা দরকার যে, সার্বিক কাজ এবং কাজের চাপের যে পরিবর্তনের চিত্র জরিপে উঠে এসেছে সেটির পেছনে ২০১৮র গেজেট এবং কোভিড-১৯ মহামারি উভয়েরই প্রভাব থাকতে পারে। জরিপে যারা কারখানা পরিবর্তন করেছেন বা করেননি এবং যারা ২০১৮র পরে কাজ শুরু করেছেন—এমন সবাইকেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে ২০১৮র গেজেট না কোভিড-১৯ মহামারি কোনটি তাদের কাজের চাপের ওপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। ৪৭% জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ মহামারি তাদের কাজের ওপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। একটি বিরাট অংশ শ্রমিক, প্রায় ৩৮% জানিয়েছেন যে ২০১৮র গেজেটের প্রভাব বেশি ছিল। বাকিরা হয় উত্তর দেননি বা নিশ্চিত ছিলেন না। ফলে, শ্রমিকদের মত অনুযায়ী ২০১৮র গেজেট ঘোষণা এবং কোভিড-১৯ মহামারি উভয়ই তাদের প্রাত্যহিক কারখানার কর্মকাণ্ড প্রভাবিত করলেও, কোনটির মাত্রা বেশি ছিল সেটি নিরূপণ করতে আরো গবেষণার দরকার।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ১২৭৮ জনের মধ্যে ৭৬% বা ৯৭২ জন নারী এবং ২৪% বা ৩০৬ জন পুরুষ। উত্তরদাতা শ্রমিকরা বাংলাদেশের পাঁচটি প্রধান শিল্প অঞ্চল—চট্টগ্রাম, ঢাকা মহানগর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের বিভিন্ন কারখানায় নিয়োজিত। উত্তরদাতাদের মধ্যে নারী শ্রমিকদের অনুপাত সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত নারীর অনুপাতের প্রতিনিধিত্ব করে।